Liberation War

“১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বোতভাবে একটি জনযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে এত ব্যাপকভাবে সর্বস্তরের জনতার অংশগ্রহণ পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে খুব কমই আছে। এ রকম একটি দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই ভিয়েতনাম যুদ্ধে। মার্কিন দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের সর্বস্তরের মানুষের যুদ্ধের সেই ইতিহাস বিশ্বব্যাপী সবারই জানা। ভিয়েতনামের মাইলাই গণহত্যার কথা বিশ্ববাসী জানে। ঠিক তেমনি এ পৃথিবী জানে ১৯৭১ এ বাংলাদেশে যে ভয়াবহ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছিলো তার কথা। নয় মাসের দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী এ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কবি-সাহিত্যিক-লেখক, সরকারী কর্মকর্তাগণ, সামরিক কর্মকর্তাগণ, পুলিশ, আইনজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতী, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষজন সর্বোতভাবে অংশগ্রহণ করে একে একটি সার্থক জনযুদ্ধে পরিণত করে। এরই সফল পরিণতি ছিলো পাকিস্তানী হানাদার, যারা ছিলো এক সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন।

কিন্তু এতো বড় এ জনযুদ্ধে জনতার বিজয় খুব সহজে আসেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন, সহযোগিতা এবং সহায়তা প্রদান ছাড়াও সামরিক অফিসারদের সহায়তা করা এবং পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং একটি আইনী কাঠামোর মাধ্যমে সেই যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে প্রশাসন পরিচালনা, সেক্টরসমূহের সাথে সমন্বয়, সহযোগিতা প্রদান, মিত্রবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা, বৈদেশিক কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা অর্জন সব মিলিয়ে এক মহা কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে হয়েছে আমাদের সকলকে। আর এ পুরো কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুঘটক ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন সেই সময়ে দায়িত্ব পালনরত মুক্তিযোদ্ধা সরকারী কর্মকর্তাগণ, যারা জেলা প্রশাসক, মহকুমা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, এস.ডি.পি.ও., ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জন, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা অর্থাৎ সিভিল সার্ভেন্টগণ।

নবীন প্রজন্মের সরকারী কর্মকর্তাগণ তাঁদের পূর্বসূরীদের আত্মত্যাগের এই সঠিক ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা জেনে গর্বিত ও আনন্দিত বোধ করতে পারেন। এ আমাদের এক অনবদ্য গৌরব ও অহংকার। তাই সেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসার প্রজন্মের উত্তরসূরী হিসেবে এ প্রজন্মের সিভিল সার্ভিসের সদস্যগণ অবশ্যই দেশমাতৃকার প্রতি আরও অনুগত ও প্রতিশ্রুতিশীল হয়ে জনসেবা করবেন এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শোষণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনামুক্ত, সকল প্রকার নির্যাতন থেকে মুক্ত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার যে সকল জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে তারও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার আমাদের সিভিল সার্ভেন্টগণ। এ সকল কিছুর মূল লক্ষ্য এদেশের সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তাদের দোরগোড়ায় সরকারী সেবা দ্রুত ও সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে পৌঁছে দেওয়া। আর সেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করে যাবেন আমাদের নবীন প্রজন্মের সিভিল সার্ভেন্টগণ, আজকের বাংলাদেশকে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে, সর্বতোভাবে সহায়তা করবেন- এ প্রত্যাশা এদেশের আপামর জনসাধারণের মতো আমরাও করি। আর তা সম্ভব হলেই আমরা বলতে পারবো আমরা মুক্তিযুদ্ধে সিভিল সার্ভেন্টগণ যে আশায় বুক বেঁধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীন করেছিলাম তারা একটি সুযোগ্য উত্তরসূরীদের হাতেই এদেশের উন্নয়ন ও প্রশাসন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রেখে যাচ্ছি।” (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সিভিল সার্ভেন্টগণের ভূমিকা; এইচ.টি.ইমাম) (বাংলাদেশ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মিলন-২০১২ এর স্মরণিকায় প্রকাশিত।)

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ক্যাডারের পূর্বসূরি তথা সি.এস.পি ও ইপিসিএস অফিসারগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। অনেকে দেশমাতৃকার জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) এর অফিসারগণের তালিকা:

Sl No. বীর শহীদগণের নাম পদবী কর্মস্থল শাহাদাৎ বরণের তারিখ
আবদুল আলী; ই.পি.সি.এস. মহাকুমা প্রশাসক রাঙ্গামাটি মহাকুমা ২৭.০৪.১৯৭১
কাজী আজিজুল ইসলাম; ই.পি.সি.এস. অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বরিশাল ০৫-০৫-৭১
আবুল কালাম শামসুদ্দিন; সি.এস.পি. মহাকুমা প্রশাসক সিরাজগঞ্জ ০১-০৫-৭১
এ কে এম শামসুল হক খান; সি.এস.পি জেলা প্রশাসক কুমিল্লা ৩০-০৩-৭১
নুরুল আমিন খান; সি.এস.পি. উপ-সচিব কৃষি মন্ত্রণালয় ২৩-০৫-৭১
আবদুর রাজ্জাক; ই.পি.সি.এস. এস.ডি.ও পিরোজপুর ০৫-০৫-৭১
মোঃ আব্দুল্লাহ; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার ভৈরব  
সাইফুল বারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান; ই.পি.সি.এস. ট্রেজারী অফিসার পিরোজপুর ০৫-০৫-৭১
মাখন লাল দাস; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার মঠবাড়ীয়া ০৭-০৬-৭১
১০ আতিক উল্লাহ্; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার পাথরঘাটা ১৫-০৫-৭১
১১ সুরেন্দ্র নাথ দত্ত; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার সরিষাবাড়ী ০৫-০৮-৭১
১২ কুদরত-ইলাহি চৌধুরী; সি.এস.পি. অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজশাহী  
১৩ আবদুল হামিদ; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার দৌলতখান ২৬-১১-৭১

তথ্য সূত্রঃ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন , মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা- কাবেদুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান-- এ এস এম সামছুল আরেফিন ।

স্বাধীনতা যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী অফিসারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

Sl No. নাম মুক্তিযুদ্ধকালীন পদবী ও কর্মস্থল
কে, এইচ, আসাদুজ্জামান; সিএসপি জয়েণ্ট সেক্রেটারী, ফিনান্স ডিপার্টমেণ্ট, ঢাকা,
এইচ, টি, ইমাম; সিএসপি ডিসি, পার্বত্য চট্রগ্রাম
জনাব আবদুস সামাদ ; সিএসপি ডিসি, সিলেট
মোহাম্মদ এন কিউ খান; সিএসপি ডিসি, পাবনা
সৈয়দ আবদুস সামাদ; সিএসপি রিহ্যাবিলিটেশন অফিসার, চট্রগ্রাম
কুদরত-ই-এলাহী চৌধুরী; সিএসপি এডিশনাল ডিসি, রাজশাহী
মোহাম্মদ খুশরুজ্জামান চৌধুরী; সিএসপি এসডিও, কিশোরগঞ্জ
কাজী রুকুনউদ্দীন আহমদ; সিএসপি এসডিও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ওয়ালিউল ইসলাম; সিএসপি এসডিও, বগুড়া
১০ আকবর আলী খান; সিএসপি এসডিও, হবিগঞ্জ
১১ কামাল উদ্দীন সিদ্দীক; সিএসপি এসডিও, নড়াইল
১২ মোহাম্মদ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীরবিক্রম; সিএসপি এসডিও, মেহেরপুর
১৩ সাদত হোসেন; সিএসপি এ্যাসিসটেণ্ট কমিশনার, যশোর
১৪ আলতাব হোসেন খান ইপিসিএস, পাবনা
১৫ যিতেন্দ্র লাল চক্রবর্তী ইপিসিএস, ফরিদপুর
১৬ আলতাব হোসেন ইপিসিএস, রংপুর
১৭ এ, কিউ এম, কামরুল হুদা ইপিসিএস, ময়মনসিংহ
১৮ মোঃ আবদুল মতিন সরকার ইপিসিএস, রংপুর
১৯ হেলাল উদ্দীন খান ইপিসিএস, ময়মনসিংহ
২০ আবদুল লতিফ ইপিসিএস, রাজশাহী
২১ আবদুল হালিম ইপিসিএস, টাঙ্গাইল
২২ জিয়াউদ্দীন আহমদ ইপিসিএস, ঢাকা
২৩ খিতিশ চন্দ্র কুন্ড ইপিসিএস, খুলনা
২৪ কাজী লুৎফর হক ইপিসিএস, ঢাকা
২৫ মাখন চন্দ্র মাঝী ইপিসিএস, কুমিল্লা
২৬ মোঃ মিজানুর রহমান ইপিসিএস, নোয়াখালী
২৭ আবদুল কাদের মুন্সি ইপিসিএস, খুলনা
২৮ দ্বীজেন্দ্র নাথ ব্যাপারী ইপিসিএস, বাকেরগঞ্জ
২৯ মানিক লাল সমাদ্দার ইপিসিএস, ফরিদপুর
৩০ আফতাব উদ্দীন ইপিসিএস, সিলেট
৩১ ক্ষান্ত মোহন দাস ইপিসিএস, সিলেট
৩২ আ(অ) মিয়াংশু সেন ইপিসিএস, সিলেট
৩৩ মোঃ ইসহাক ইপিসিএস, চট্রগ্রাম
৩৪ মোঃ আবদুল আলী ইপিসিএস, ফরিদপুর
৩৫ একেএম রুহুল আমিন ইপিসিএস, কুমিল্লা
৩৬ ইয়াকুব শরিফ ইপিসিএস, বাকেরগঞ্জ
৩৭ প্রিয়দারঞ্জন দাস ইপিসিএস, চট্রগ্রাম
৩৮ জ্ঞানরঞ্জন সাহা ইপিসিএস, বরিশাল
৩৯ অমরেন্দ্র মজুমদার ইপিসিএস, নোযাখালী
৪০ গোলাম আকবর ইপিসিএস, ঢাকা
৪১ দীপক কুমার সাহা ইপিসিএস, পাবনা
৪২ অনিল চন্দ্র সাহা ইপিসিএস, ময়মনসিংহ
৪৩ সুবীর কুমার ভট্রাচার্য ইপিসিএস, বরিশাল
৪৪ আবদুল লতিফ ভূঁইয়া ইপিসিএস, কুমিল্লা

তথ্য সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা
(কাবেদুল ইসলাম)